প্রতিটি ঘরের উঠোন, দরজা ও ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে অলঙ্কার তৈরির সরঞ্জাম। বেশির ভাগ বাড়ির বারান্দায় উজ্জ্বল আলোয় উঁকি দিচ্ছে আগুনের ফুলকি। পুরো গ্রামেই চলছে এ কর্মযজ্ঞ। ছেলে-বুড়ো, মা-মেয়ে-বউ সবাই ব্যস্ত গলার হার, হাতের চুড়ি, কানের দুল, ঝুমকা, চেন, পায়েল ও নূপুর তৈরিতে। রাস্তার পাশে, বাজারে বাজারে গড়ে উঠেছে গয়নার কারখানা ও দোকান। এ দৃশ্য সাভারের হেমায়েতপুরের ভাকুর্তা গ্রামের। রাজধানী ঢাকার সন্নিকটে অবস্থিত হলেও অবহেলিত জনপদ ছিল এই ভাকুর্তা। শিক্ষার দিক দিয়ে অনেক পিছিয়ে ছিল। বেকার জীবনযাপন ছিল বেশির ভাগ মানুষের। এই জনপদে আজ আর কেউ বেকার নেই। ছোট-বড় নারী-পুরুষ সবাই ব্যস্ত তামা ও পিতল দিয়ে গয়না তৈরিতে। সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত ঠুকঠাক শব্দে নানা ধরনের গয়না তৈরিই তাদের পেশা। সংসারে ফিরে এসেছে সচ্ছলতা। এ জনপদকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে গয়না শিল্প।
এ ইউনিয়নের ২৭ গ্রামের ১২টিতেই ঘরে ঘরে তৈরি হয় গয়না। গয়না তৈরির গ্রামগুলো হলোÑ ভাকুর্তা, কান্দিভাকুর্তা, হিন্দুভাকুর্তা, মোগরাকান্দা, মুশুরিখোলা, ডোমরাকান্দা, বাহেরচর, ঝাউচর, লুটের চর, চুনার চর, চাপড়া ও চাইরা। এসব গ্রামের প্রায় ১০ হাজার লোক গয়না তৈরির কাজে যুক্ত। এই গয়না তৈরি করে যেমন অন্যকে সাজতে সহায়তা করছেন, তেমনি একে অবলম্বন করে নিজেদের জীবনকেও সাজাচ্ছেন এখানকার মানুষ। বছরে গড়ে প্রায় আড়াই কোটি টাকার গয়না তৈরি হয় এ গ্রামে। গ্রামগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান উৎস গয়না তৈরি করা। নারী-পুরুষ মিলে মেয়েদের গয়না তৈরি করেন, যেগুলো বিক্রি হয় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায়।
স্বর্ণ ও রৌপ্যের উচ্চমূল্যের কারণে সাভারের ভাকুর্তা বাজার ও এর আশপাশের গ্রামগুলোতে গয়না তৈরি করা হয় তামা ও পিতল দিয়ে। প্রাথমিকভাবে এগুলো অপরিশোধিত অবস্থায় থাকে। এখান থেকে পাইকাররা কিনে নিয়ে পরিশোধন ও রঙ করে বাজারে বিক্রি করে থাকেন, যা সিটি গোল্ড বা ইমিটেশন নামে পরিচিত। এগুলো দেখতেও যেন সোনার মতো তা সবার জানা। এখানে তামার ব্যবহার বেশি হলেও পিতল ও দস্তা দিয়েও গয়না তৈরি করেন কারিগররা। জানা যায়, ’৮০-এর দশকেও এই বাজারে সোনা ও রুপার গয়না তৈরি হতো। কিন্তু এগুলোর দাম বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যবসায়ী ও কারিগররা সোনা ও রুপার অলঙ্কার তৈরি থেকে সরে আসেন। ’৯০-এর দশকে এসে ঝুঁকে পড়েন ইমিটেশনের গয়না তৈরির দিকে।
সরেজমিন ভাকুর্তায় দেখা যায়, গ্রামের নামেই গড়ে উঠেছে বাজার। সেখানে রয়েছে বিরাট একটি বটগাছ। সেই বটগাছ ঘেঁষে সারি সারি গয়নার দোকান। কিছু পাকা, কিছু আধা পাকা, আবার কিছু টিনের ঘর। এর মধ্যে বসে দিব্যি কাজ করছেন বিভিন্ন বয়সী কারিগর ও তাদের সহকারীরা। কারিগররা অত্যন্ত মনোযোগ সহকারে তৈরি করছেন গলা, নাক, কান, পা, কোমর ও মাথার বিভিন্ন ডিজাইনের গয়না। সোনার দোকানে যেসব জিনিস থাকে তার যেন সবই রয়েছে ঘরগুলোতে। সামনে, পেছনে, দেয়ালে থরে থরে সাজানো মেয়েদের বিভিন্ন ধরনের গয়না। গয়না তৈরিতে যত কাঁচামাল প্রয়োজন, সবই সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। গয়না তৈরির কাঁচামাল বিক্রির দোকানের মালিক ও কারিগর অনীল রাজবংশী। তার সাথে কথা বলে জানা গেল, তিন প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজ করছেন। গ্রামের প্রায় সবার পেশা গয়না গড়া। বাজারের সব ঘরই সাজানো-গোছানো। আমেনা জুয়েলারি ওয়ার্কশপের মালিক মো: সাদেক মিয়া জানান, গয়না তৈরির কাজটি আগে হিন্দুরা করতেন। মুসলমানেরাও এটিকে এখন পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। তিনি আরো জানান, তাদের তৈরি গয়নাগুলো পাইকারের কাছে বিক্রি করা হয় ২০ টাকা থেকে এক হাজার ৫০০ টাকায়। দাম ডিজাইন ও আকারের ওপর নির্ভর করে। যেমন গলার নেকলেস ১০০ থেকে এক হাজার টাকা, চুড়ি ২০০ থেকে ৩০০ টাকা জোড়া, সিতা হার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ১০০ টাকা, নূপুর ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার ঝাপটা ১৫০ থেকে ২৫০ টাকা, হাতের মালতাশা ২০০ থেকে ৩০০ টাকা, খোঁপার কাঁটা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, মাথার টায়রা ৩০০-৪০০ টাকা, শাড়ির মালা ২৫০ থেকে ৫০০ টাকা, নাকের ফুল ২০ থেকে ৩৫ টাকা, কপালের টিকলি ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এসব গয়নার বেশির ভাগই অপরিশোধিত অবস্থায় বিক্রি হয়। পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে পরিশোধন করে যখন মার্কেটে খুচরা বিক্রি করেন তখন এর দাম দেড় থেকে দুই গুণ, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিন গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
ভাকুর্তা বাজারের কারিগর বেচারাম দেওরি জানান, গয়না তৈরির কাঁচামাল তামা কিনে নিয়ে আসা হয় ঢাকার কোতোয়ালি থানার তাঁতিবাজার থেকে। দাম পড়ে কেজিপ্রতি এক হাজার টাকা থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া কিছু গয়নার কাঁচামাল বগুড়া ও ভারত থেকে নিয়ে আসা হয়। নিজেদের দক্ষতা ও পরিশ্রম দিয়ে কাজ করেন কারিগররা। দিনে ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করে আয় হয় ৬০০ থেকে ৭০০ টাকা।
ভাকুর্তা বাজারের স্বর্ণ, রৌপ্য ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি নাজিম উদ্দিন জানান, ভাকুর্তা বাজারের বয়স প্রায় ১৫০ বছর। এ বাজারে দোকান রয়েছে ১৩০টির মতো। আর ভাকুর্তা ইউনিয়নে কমপক্ষে ২৫০-৩০০টি দোকান। আট থেকে ১০ হাজার মানুষ এই পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন।
প্রতিটি পরিবারের কমপক্ষে একজন সদস্য এই পেশায় জড়িত রয়েছেন। তিনি বলেন, ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় যেসব ইমিটেশন বা সিটি গোল্ডের গয়না বিক্রি হয় তার বেশির ভাগই এখানে তৈরি হয়। এ ছাড়া স্বল্পসংখ্যক মধ্যপ্রাচ্য, ভারত, ইতালিতেও রফতানি করা হয়।
দেশের বিভিন্ন প্রান্তের প্রায় সব বড় শপিংমল, ঢাকার নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, চাঁদনী চকসহ সব মার্কেটেই গয়না আসে ভাকুর্তা গ্রাম থেকে। মার্কেটগুলোতে সিটি গোল্ড বা এন্টিক নামে এসব গয়না বিক্রি হয়। এ ছাড়া গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, মুন্সীগঞ্জ, চট্টগ্রাম, ফরিদপুর, খুলনা, বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চল গয়নার বৃহত্তর বাজার। পাইকাররা এসে গয়না কিনে নিয়ে যান। শুধু দেশে নয়, এখানকার গয়নার চাহিদা দেশের সীমা ছাড়িয়ে বিদেশেও।
স্থানীয় লোকজন জানান, ব্রিটিশ আমলেই এখানকার মানুষ গয়না তৈরিকে বিকল্প পেশা হিসেবে বেছে নেন। শুরুতে তারা সোনার গয়না বানাতেন। ধীরে ধীরে রুপার গয়না গড়ার দিকে ঝোঁকেন তারা। বর্তমানে তামা ও পিতলের তৈরি গয়নাই বেশি গড়ছেন। ১৯৮০ সালের পর থেকে গয়না তৈরি ও বিক্রি ছড়িয়ে পড়ে। প্রথম দিকে রসময় পোদ্দার, জগন্নাথ পোদ্দার, শচীন্দ্র সরকারসহ কয়েকজন স্থানীয়ভাবে গয়না তৈরি শুরু করেন। পরে রাজেশ দাস, নিতাই দাসসহ কয়েকজন এর বাণিজ্যিক প্রসার ঘটান।
ভাকুর্তা সোনা, রুপা ও ইমিটেশন ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মো: নাজিমুদ্দীন বলেন, রুপার মূল্য বৃদ্ধির ফলে এখন তারা তামা-পিতল দিয়ে কাজ করেন। সোনার আকাশছোঁয়া দামের কারণে অনেকের পক্ষে সোনার গয়না কেনা সাধ্যের বাইরে। তাই তামা-পিতলের গয়নাই এখন সম্বল। সিটি গোল্ড বা এন্টিক নামে এগুলোর পরিচয়। সোনা ও রুপার উচ্চমূল্যের বাজারে তামা, দস্তা, পিতলই ভরসা। সাধারণ একটি অপরিশোধিত তামার গয়নার দাম ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, যা জিংকে ধুয়ে পরিশোধিত হয়ে এক হাজার ৫০০ থেকে দুই হাজার টাকায় বিক্রি করা যায়। ডিজাইন অনুযায়ী দাম কম-বেশি হয়।
ভাকুর্তা বাজারের গয়নার কারিগর অখিল সরকার জানান, এক সময় আমরা রুপার গয়না তৈরি করতাম। দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় এর বিক্রি কমে যাচ্ছে। তাই এখন তামা আর পিতল বেশি ব্যবহার করি। ঢাকার চাঁদনী চক, নিউমার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেটসহ প্রায় সব বড় মার্কেট ও শপিংমলে ভাকুর্তার গয়না যায়।
দিনে দিনে এসব গয়নার চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় পুরুষের পাশাপাশি ভাকুর্তায় নারী সদস্যরাও সমানতালে অলঙ্কার তৈরির কাজ করে যাচ্ছেন। ডোমরাকান্দা গ্রামের গৃহবধূ রোজিনা আক্তার, চুনারচরের স্কুলছাত্রী নাসিমা আক্তারসহ অনেকেই জানায়, ঘরসংসার ও পড়াশোনার পাশাপাশি তারা অলঙ্কার তৈরি করে পরিবারে সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছে।
রাজধানীর জুয়েলারি দোকানগুলোতে ভাকুর্তায় তৈরি অলঙ্কারের চাহিদা স্বর্ণের চেয়েও বেশি। নিউমার্কেটের মোস্তফা জুয়েলার্সের মালিক আরিফুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, দফায় দফায় স্বর্ণের দাম বাড়ায় ব্যবসায় মন্দা চলছে। তার ওপর ৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। যার ফলে স্বর্ণে লাভ খুবই কম। এ কারণে রুপা, তামা ও পিতলের অলঙ্কার বিক্রি করছি। মানুষ এসব অলঙ্কার বেশি কিনছে।
ভাকুর্তা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ মো: আনোয়ার হোসেন জানান, দেশের এ রকম ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে সাধারণ ক্রেতার পাশাপাশি সরকার ও সংশ্লিষ্ট মহলকেও এগিয়ে আসতে হবে। এ শিল্পের সাথে জড়িতদের সহজ শর্তে ঋণ দিয়ে তাদের পুঁজি বৃদ্ধি ও ব্যবসায় প্রসারে সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা চান তিনি। এ ছাড়াও এ শিল্পের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাজারজাতকরণে সঠিক প্রচারণায় সরকারি সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন তিনি।