শুক্রবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০১৭

মেয়েদের শ্বশুর বাড়ি


তুলি স্কুল মাষ্টারের মেয়ে। মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হওয়ায় তার তেমন কোন সখ-আল্লাদ পুরন হয়নি। তার স্বপ্ন বিয়ের পর শশুর বাড়ি গিয়ে নিজের মতো গুছিয়ে সংসার করবে। আজ তার বিয়ে। মনে মনে সে কতো কথাই চিন্তা করছে। কি কি করবে, কিভাবে মিলে-মিশে থাকবে নতুন নতুন মানুষদের সাথে। তার স্বামী কেমন হবে! সে কি শান্ত প্রকৃতির হবে!.. তাকে কি অনেক ভালবাসবে!  নাকি অনেক রাগি হবে। ...... তার ভাবনার অবসান ঘটলো যখন কাজী সাহেব এসে দাড়ালেন তার পাশে।
গ্রামের বিয়েতে তেমন কোন অনুষ্ঠান হয়না। তার উপর মধ্যবিত্ত পরিবার।
বিয়ের প্রথম পর্ব শেষ করে বিদায় নিয়ে সে পা রাখলো শশুর বাড়ি। ................................
কাগজের ফুল দিয়ে সাজানো ঘরে খাটের ঠিক মাঝখানে ১ হাত ঘোমটা দিয়ে বসে আছে তুলি।
আতিক এসে ঘরের মধ্যে। (আতিক হচ্ছে তুলির স্বামী)
দরজা বন্ধ করে দিয়ে খাটের  পাশে গিয়ে দাড়ালো। তুলি খাট থেকে নেমে আতিক কে সালাম করলো।
তুলি আবার গিয়ে খাটে বসে পরলো। আতিক অনেক শান্ত ছেলে। সে তুলিকে বলল, তুমি কি আমার পরিবার কে তোমার নিজের পরিবার মনে করে চলতে পারবে। আমার মা কে নিজের মা, আর বাবাকে নিজের বাবা ভাবতে পারবে। তুলি শুধু মাথা নেরে হ্যাঁ বলল,।।
সকালে কোন এক জনের রাগি কণ্ঠের শব্দে তুলির ঘুম ভাংলো।
এই যে নবাবের বেটি অহনো ঘুম ভাংগে নাই। নতুন বউ এতো ঘুম কিসের শুনি। বাড়িতে কি দশ-বারটা দাশী-বান্দি আছে,  তারা কাজ করে দিবে।
আতিক ঘর থেকে বেড় হয়ে এলো।
মা সকাল সকাল কি শুরু করছো। নতুন বউ কি মনে করবে কথা গুলো শুনলে।
শুনলে শুনবে কি হয়েছে। সারা জিবন সংসারের ঘানি টানলাম এখনো তাই করতে হবে। আমার পোরা কপাল।
কথা শেষ না হতেই তুলি ঘর থেকে বেড় হলো। তুলিকে দেখে তার শ্বাশুরি বলল, নবাবের বেটির ঘুম কি শেষ হয়েছে.. এবার গতরটা একটু খাটাও। গোয়ালে গরু গুলো না খেয়ে আছে। কখন থেকে গরু গুলো ডাকাডাকি করছে।
তুলি কোন কথা না বলে চলে গেলো গোয়াল ঘরের পাশে খড়ের পালার কাছে। এর আগে সে কখনো এমন কাজ করেনি। আনেক কষ্টে খড়ের পালা থেকে খড় নিয়ে গরুর চারিতে দিয়ে আসলো। তার দু'চোখ দিয়ে পানি পরছে।
পিছন থেকে কেউ একজন তাকে ডেকে বলল, বাপ-মায় কি কিছুই শিখায় নি। গরুর মুখে খড় দিলেই কি গরু খায়। পানি দিয়ে ভিজিয়ে দিতে হয় এই বুদ্ধি টুকুনও নাই।
পিছন ফিরে দেখলো তার শ্বাশুরি কথা গুলো বলছে। তুলি কিছু বলতে পারছে না। শুধু দু'চোখ দিয়ে পানি ফেলছে। আর মনে মনে বলছে, মা আমি কি তোমাদের কাছে বোঝা হয়ে গিয়েছিলাম! তাই এমন বাড়িতে বিয়ে দিয়ে দিলে।
এই ভাবেই কাটছিল তার দিন। বিয়ের ২ দিন পর মেয়েকে নিতে আসে বাবার বাড়ির লোক জন এটাই নিয়ম। কিন্তু তুলির তা হলো না। তার শাশুরি বলে দিয়েছে তিনি যেদিন চাইবেন সেদিন তুলি বাপের বাড়ি যেতে পারবে।
তুলির শ্বশুরটা একদম সাদা-সিধে। বেশির ভাগ সময়ই জমিতে কাজ করেন। মাঝে মাঝে তুলির সাথে কথা হয়।
দেখো মা তোমার শাশুরির কথায় কষ্ট পেয়েও না। মানুষটা এমনই। তার জন্মের সময় তার মায়ে তার মুখে মধু দেয় নাই হয়তো তাই এমন হয়েছে সে। তেমার যদি কিছু দরকার হয় আমাকে নিজের বাবা মনে করে বলবে। আমার ছেলে তো ঢাকা গিয়ে ভালই আছে। এদিকে তার বউ কেমন আছে একটা খোজও নিচ্ছে না। একটা চিঠি দিতে কি অনেক কষ্ট হয়।
বাবা আপনি ভুল ভাবছেন। তিনি হয়তো কাজের চাপে সময় করে উঠতে পারছেন না। তাই চিঠি দিচ্ছেন না।
তাও হতে পারে।
তার শশুরের কথা শেষ না হতেই....
কাজ কাম ছিকেয় তুলে সারা দিন বসে বসে গল্প করলেই হবে?.. বাপের বাড়ি থেকে কি দাসি-বান্দি নিয়ে আইছো তারা করে দিবে?..
কথা গুলো শুনে তুলির শশুর জমির দিকে যেতে শুরু করলেন।
এই যে আপনি আবার কই যান। দুইটা ভাত গিলে আমাকে উদ্ধার করে সেখানে খুশি চলে যান। আমার হয়েছে যতো জালা। এতো দিন ওনাকে নিয়েই আমার হাড়-মাংশ কালা হয়ে গেল। তার উপর জুটেছে কাম চোরা বউ।
তুলির শাশুরির কথা শেষ হওয়ার আগেই তার শশুর বাড়ির বাইরে চলে গেছেন।

অনেক দিন হয়ে গেল মেয়েটার কোন খবর নেওয়া হয়নি। কেমন আছে আমার মেয়েটা। আপনি একবার দোখে আসেন না মেয়েটাকে। তুলির মা তুলির বাবাকে বলল।
তুলির বাবা বলল, আমিও ভাবছি কাল একবার যাবো তুলিকে দেখতে অনেক দিন হলো মেয়েটাকে দেখি না।
পরের দিন সকালে তুলির বাবা মেয়েকে দেখতে রওনা হলেন।
দুপরের দিকে তুলি বাড়ির উঠানে কাজ করছিল। এমন সময়..
মা তুলি কেমন আছিস।
পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখলো তার বাবা দই-মিষ্টি হাতে দাড়িয়ে আছে।
আব্বা আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? মা কেমন আছে। আসতে কোন কষ্ট হয়নি তো। ঘরে চলেন।
তুলি কে দেখে তার বাবার মুখ শুকিয়ে গেল। মেয়েকে যেন চিনতেই পারছেন না তিনি। অনেক শুকিয়ে গেছে। চোখের নিচে কালো হয়ে গেছে।
কে এসেছে? কার সাথে গল্প শুরু করেছো কাম বাদ দিয়ে।
মেয়ের শাশুরিকে দেখে তুলির বাবা বললেন, বেয়ান কেমন আছেন। বেয়াই কই দেখতে পাচ্ছি না তো।
তা ভালোই আছি। ঘরে গিয়ে বসেন। কতো দুর থেকে এসেছেন।
বিকালের দিকে আতিক ঢাকা থেকে বাড়ি আসে। এসেই শশুরের সাথে দেখা।
কেমন আছেন আব্বা, বাড়ির সবাই ভালো তো। মা কেমন অাছেন।
তুলির বাবা কথা গুলোর উত্তর দেওয়ার আগেই রান্না ঘর থেকে তার মা বলে উঠলো, ছেলেকে এতো
কষ্ট করে পড়ালেখা করাইলাম আজ সেই ছেলে বউয়ের মা বাপ কেমন আছে আগে জানতে চায় নিজের মার কথা তো মনেই পরে না।
কথা গুলো শুনে আতিক লজ্জায় আর তার শশুরের সামনে থাকতে পারলো না। মাথাটা নিচু করে ঘরের মধ্যে চলে গেল।
রাতে আতিক, আতিকের বাবা, আতিকের শশুর এক সাথে খেতে বসেছে। তুলি তাদের খাবার বেড়ে দিচ্ছে।
আব্বা আরেকটু তরকারি নেন।
না মা আমার খাওয়া শেষ রে।
কি খেলেন বেয়াই আরেকটু ভাত নেন। আতিকের বাবা বলল।
তুলির বাবা বলল, না বেয়াই অনেক খেয়েছি আর পারবো না।
এমন সময় আতিকর মা এসে তুলির বাবার প্লেট-এ অনেক গুলো ভাত দিয়ে বাটিতে রাখা সব তরকারি তার প্লেটে ঢেলে দিতে দিতে বলল, খান খান এই প্রথম মেয়ের বাড়ি আসলে তাও আবার খালি হাতে তাই বলে কি আমরা না খাইয়ে বিদায় দিবো।
তুলি কান্না করতে করতে ঘরে চলে গেল। পরিবেশটা একদম শান্ত হয়ে গেল। আতিক না খেয়ে উঠে পরলো। তুলির বাবা কি করবেন বুঝতে পারছেন না। তার চোখে পানি চলে এসেছে। মনে মনে ভাবছেন "আমার মেয়েকে কোথায় বিয়ে দিলাম"
আতিক ঘড়ে গিয়ে তুলিকে বলল, তোমার কাপড় গুছিয়ে নাও। সকালে তুমি তোমার বাবার সাথে চলে যাবে। এখানে তোমাকে আর থাকতে হবে না। আমি ঢাকা গিয়ে নতুন বাসা নিয়ে তোমাকে নিয়ে যাবো।
তুলি কান্না করতে করতে কাপড় গোছাতে শুরু করলো।
আতিক তার মা কে গিয়ে বলল, তুমি যা শুরু করেছ তা আর সহ্য করতে পারলাম না। তাই তুলিকে ওর বাবা সাথে পাঠিয়ে দিবো কাল। এইটা বলেই সে তার মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে আসলো।
পরের দিন সকালে....
কই নবাবের বেটি। বাপের বাড়ি যাবে না সে। এখনো ঘুম ভাংগে না।
তুলি দরজা খুলে দেখলো তার শ্বাশুরি একটা নতুন শাড়ি আর কিছু গহনা হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। তুলিকে বলল, এই প্রথম বাপের বাড়ি যাচ্ছ এই গুলো পরে যাও। শাড়িটা কিছু দিন আগে তোমার শশুরকে দিয়ে তোমার জন্য কিনে আনিয়েছি। আর গয়না গুলো আমার শাশুরি আমাকে দিয়েছিলেন। আমি জানি তুমি আমার উপর রেগে আছো। কি করবো বলো, আমি যখন এই বাড়িতে বউ হয়ে আসি তখন আমার বয়স ছিল ৮ বছর। শাশুরির কথা শুনতে শুনতে আমিও এমন হয়ে গেছি। অনেক দিন না খাইয়ে রেখেছে। সারা দিন গাধার মতো কাজ করতে হতো। তারপরও কথা শুনতে হতো। আমি তো তোমার সাথে এমন ব্যবহার করতে চাই না। তুলির শাশুরি কান্না করতে লাগল। তুলির চোখেও পানি।
আম্মা আমি আপনাকে ভুল বুঝে ছিলাম। আমাকে মাপ করে দিন। এই বলে তুলি তার শাশুরিকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করলোা
আরে পগলি মেয়ে কানছো কেনো। যাও তৈরি হয়ে নাও বেলা তো আর কম হলো না। কথাটা শেষ করে তুলির শাশুরি চোখ মুছতে মুছতে ঘর থেকে বেড় হলেন।
তুলি আর তুলির বাবা যখন রওনা হলো তখন আতিকের মা - বাবা দুজনেই তাদের বিদায় দিতে উঠানে দাড়িয়ে আছে। তুলি তাদের সালাম করলে রওনা দিবে এমন সময়, "এই যে নবাবের বেটি বেশি দিন না থেকে তারাতারি চলে এসো" অাজ কথাটাতে কোন রাগ নাই আছে শুধু ভালাবাসা আর স্নেহ। হাসি মুখে তারা বিদায় নিল।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন