জোনাকি এক ধরনের পোকা। বিটিল শ্রেণীর এই পোকাকে ইংরেজিতে
বলে লাইটিং বাগ বা ফায়ার ফ্লাই। বিটিল শ্রেণীর পোকাদের আছে অনেক ভাগ। শুধু ল্যামপাইরিডি
পরিবারের বিটিল পোকাদেরই জোনাকি পোকা বলা হয়। যদিও এদের নামে ফ্লাই বলা হয় (ফ্লাই মানে
মাছি), তবে এরা কেউই আসলে মাছি নয়। ছোট্ট কালচে বাদামী
রঙের পোকা, একটু লম্বাটে গড়নের। পোকার পেটের পেছনে থাকে সেই
আলো জ্বলা অংশ। আমাদের দেশ থেকে শুরু করে মালয়েশিয়া-আমেরিকা পর্যন্ত অনেক দেশেই জোনাকি
পোকা আছে। পৃথিবীতে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির জোনাকি পোকা আছে। এরা একেবারেই সাদাসিধে
পতঙ্গের মতো। লম্বায় এক ইঞ্চিরও কম- দুই সেন্টিমিটার। পাখা আর মাথায় হলুদ লম্বা দাগ
আছে। ছয়টা পা, দু’টো অ্যান্টেনা, অক্ষিগোলক আর শরীরটা তিন ভাগে বিভক্ত। প্রতিটি জোনাকি শরীরের শেষ ভাগে একটা করে
বাতি নিয়ে ঘোরে। প্রত্যেক প্রজাতির জোনাকি পোকার আলো কিন্তু এক রকম নয়, আলাদা। কোনো কোনো জোনাকি পোকার আলোর রং সবুজ, কারো আলো হলুদ আবার
কারো বা কমলা। শুধু রঙই আলাদা নয়,
ওদের আলোর সঙ্কেতও ভিন্ন ভিন্ন।কিছু
হবে না।
নানা দেশে নানা নামে ইংরেজিতে এদের অনেক নাম ফায়ারফ্লাই,
ফায়ারফ্লাই বিটল, গ্লো ওয়ার্ম, গ্লো ফ্লাই, মুন বাগ, লাইটেনিং বাগ, গোল্ডেন স্পার্কলার। জাপানিজরা হোটারু, জ্যামাইকানরা বিৎলংকি, মালয়ালামরা মিন্না-মিন্না, স্প্যানিশরা লুইসিয়েরনাগা, পর্তুগিজরা লাগা-লাম, মালয়রা কেলিপ-কেলিপ, কুনাং-কুনাং, অ্যাপি-অ্যাপি, জার্মানরা লুশেটক্যাফার, ফরাশিরা লুসিয়ল, ইতালিয়ানরা লুসিঅলা এবং থাইরা হিং হোয় বলে ডাকে। আলো জ্বলা-নেভার কারণ জোনাকিরা
অবিরাম আলো জ্বালায় না। ওদের আলো জ্বলে আর নেভে। কিন্তু কেন ওরা আলো জ্বালে তা কি জানো? তোমাদেরকে অন্ধকারে পথ দেখাতেই কি ওদের এই আলো জ্বালানো খেলা? একটু গরম ও বর্ষা পড়তেই জোনাকি পোকারা ওদের ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে।
জোনাকি পোকাদের মধ্যেও ছেলে ও মেয়ে আছে। পুরুষ পোকারা স্ত্রী পোকাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব
করার আশায় আলো জ্বেলে ঝোপ-ঝাড়ে উড়তে থাকে। আর মেয়ে পোকারা ঝোপ-ঝাড়ের নিচে, ঘাসের পরে,
মাটিতে বসে মেয়ে পোকাদের
জ্বালানো আলো দেখার অপেক্ষায় বসে থাকে। এবং বেছে নেয় বন্ধুকে। তখন মেয়ে পোকারাও আলো
জ্বালতে থাকে। এজন্য জোনাকি পোকাদের চলমান বাতিও বলা হয়।
অনেক প্রজাতির জোনাকি পোকা আছে।
কিন্তু এক প্রজাতির পোকার সাথে অন্য প্রজাতির আলোক সঙ্কেত হুবহু মেলে না। তাই নির্দিষ্ট
প্রজাতির জোনাকি পোকারাই সেসব আলোক সঙ্কেত চিনে তার স্বজাতির পুরুষ পোকাদের বন্ধু হিসেবে
গ্রহণ করে। সঙ্কেত ঠিক মতো না চিনতে পারলেই বিপদ! এক প্রজাতির মেয়ে জোনাকি পোকা কখনো
অন্য প্রজাতির ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে পারে না, এটা ওদের সমাজে অন্যায়। যদি নেহায়েত এমন দুর্ঘটনা কখনো ঘটে যায়, তাহলে কাছে আসার পর মেয়েটো ছেলে জোনাকিকে ফাঁদে ফেলে মেরে ফেলে।
আসলে জোনাকি পোকারা আলো জ্বেলে একে অপরের সঙ্গে সঙ্কেত আদান-প্রদানের মাধ্যমে কথা বলে, ভাব বিনিময় করে। আলো না জ্বললে এটা কখনো সম্ভব হতো না। ফলে জোনাকিদেরও
আর কোনো বাচ্চা হতো না। আর পৃথিবী থেকে জোনাকিরা হারিয়ে যেত।
জোনাকির এই আলো জ্বালারও একটা
রহস্য আছে। ওদের পেছনে বা লেজে দু’টো রাসায়নিক পদার্থ থাকেÑ লুসিফেরাজ ও লুসিফেরিন। লুসিফেরাজ একটি এনজাইম যা আলো ছড়ায়।
আর লুসিফেরিন তাপ প্রতিরোধী যা আলোকে ঠাণ্ডা রাখে। জোনাকি পোকারা তার শক্তির শতভাগই
আলোতে পরিণত করতে পারে। অন্যদিকে একটি সাধারণ বৈদ্যুতিক বাতি তার শক্তির মাত্র দশ ভাগ
আলোতে পরিণত করতে পারে, বাকি নব্বই ভাগ শক্তিই তাপে পরিণত
হয়। সেজন্য জোনাকির আলোতে কোনো তাপ হয় না।
জোনাকির ঘরবাড়ি
জোনাকিদের সব সময় দেখতে পাওয়া যায়
না। তাহলে ওরা থাকে কোথায়? যায়ই বা কোথায়? জোনাকিরা সাধারণ ভেজা জায়গা পছন্দ করে। তাই জলাশয়ের ধারে ওদের
বাড়ি বানায়। এর মানে এই নয় যে,
ওদের খুব পানির দরকার।
পুকুর, ডোবা, নালা, খাল, বিল, নদী একটা কিছু হলেই হলো। ওরা তার
পাড় ধরে গজিয়ে ওঠা ঘাস ও ঝোপ-ঝাড়ে বাসা বাঁধে। লম্বা ঘাস ওদের পছন্দ। সেসব ঘাস বা ঝোপের
গাছেই ওরা থাকে, গাছই ওদের ঘরবাড়ি। তবে ওদের সবসময়
গাছে দেখা যায় না। দিনের বেলায় লুকিয়ে থাকে গাছের বাকলের তলে, গাছের গর্তে বা ফাটলে,
শুকনো পাতার নিচে, ঘাসে। রাত হলেই বেরিয়ে আসে। শীতেও ওদের তেমন দেখা যায় না। ওরা
স্যাঁতসেঁতে জায়গা পছন্দ করে। কোনো কোনো প্রজাতির জোনাকি পোকার বাচ্চারা জলে থাকে এবং
সেখানে মাছের মতোই তারা প্রায় বছর খানেক বেঁচে থাকে। এন্টার্কটিকা মহাদেশ ছাড়া পৃথিবীর
আর সব মহাদেশেই জোনাকি দেখা যায়।
জোনাকির খাবার-দাবার
জোনাকি পোকার বাচ্চারা মাটিতে, গাছের বাকলের নিচে ও স্যাঁতসেঁতে জায়গায় থাকে। তারা সেখান থেকে
কেঁচো, শামুকের বাচ্চা ও পচা জায়গায় থাকা
অন্যান্য পোকার বাচ্চা খায়। এমনকি পচা প্রাণী ও আবর্জনাও খায়। বাচ্চারা দেখতে অনেকটা
শুকনো পাতার মতো, তবে খুবই ছোট। বাচ্চাদের মুখে
কাঁচির মতো ধারাল এক ধরনের অঙ্গ আছে। সেটা দিয়েই ওরা শত্রুকে ঘায়েল করে। শত্রুর আকার
বড় হলে কয়েকজন মিলে তাকে আক্রমণ করে। মুখের সামনের ধারাল অঙ্গ শত্রুর শরীরে ঢুকানোর
সঙ্গে সঙ্গে ওরা এক ধরনের বিষ ছেড়ে দেয়,
যার প্রভাবে শিকার অবশ
হয়ে যায়। এরপর তারা সবাই মিলে সেটা খায়।বড় হওয়ার পর বাচ্চাদের চেহারা বদলে যায়। তখন
তারা আলো জ্বালতে শুরু করে। তবে কোনো কোনো প্রজাতির জোনাকির বাচ্চা এমনকি ডিম থেকেও
আলো বের হয়। জোনাকিরা বড় হলে তারা মাত্র কয়েক মাস বাঁচে। তাই তখনো তাদের খেতে হয়। তবে
আর তারা পচা আবর্জনা ও মরা প্রাণী খায় না। বড় হওয়ার পর তারা গাছ থেকে গাছে, ফুল থেকে ফুলে ঘুরে বেড়ায় আর পরাগরেণু
ও মধু খায়। কখনো কখনো মেয়ে জোনাকিরা ক্ষেপে গেলে অন্য প্রজাতির পুরুষদের ভুলিয়ে ভালিয়ে
কাছে ডেকে নিয়ে আসে ও তাদের কামড়ে খায়। দুষ্টুমি করেও তারা এটি করে। কিন্তু বড়রা বাঁচে
অল্পদিন, মাত্র কয়েক মাস। বড় মেয়ে জোনাকিরা ডিম পাড়ার পরই মারা যায়, পুরুষরা মরে যায় তার আগেই।
জোনাকিদের শত্রু
এদেরও শত্রু আছে। তারা এদের শিকার
করে খায়। এ জন্য জোনাকিরাও কম চালাকি জানে না। ওদের কেউ শিকার করতে এলে ওরা এক ফোঁটা
রক্ত ছেড়ে দেয়। সেই রক্তবিন্দু যেমন তিতা তেমনি বিষাক্ত। তাই ওদের আর কেউ শিকার করতে
আগ্রহ দেখায় না। এমনকি টিকটিকি,
সাপও ওদের শিকার করতে সাহস
পায় না। তাই বলে ভেব না যে ওরা দুর্বোধ্য,
কেউই ওদের বধ করতে পারে
না। বাদুড়ের সঙ্গে ওরা পেরে ওঠে না। রাতে বাদুড় বেশ ভালোই দেখতে পায়। তার ওপর আবার
জোনাকিরা যখন আলো জ্বেলে চলাফেরা করে তখন বাদুড় ওদের শিকার করে খায়।
আমি যে কারণে জোনাকি চাষ করতে চাচ্ছি
গবেষকরাও বলছেন, দুনিয়া থেকে নাকি জোনাকির সংখ্যা কমে গেছে। আর এই কমে যাওয়ার
মূল কারণ হচ্ছে আলো দূষণ। তোমার কাছে কথাটা অন্য রকম মনে হতে পারে। রাতের ঝলমলে আলোর
কারণে কীট-পতঙ্গসহ নানা পশুপাখির খুব অসুবিধা হয়। বিশেষ করে যেসব প্রাণী নিশাচর, তাদের তো খুবই অসুবিধা। আর এটাই হচ্ছে আলো দূষণ। এই আলো দূষণের
কারণেই কমে যাচ্ছে নিশাচর প্রাণী। এর মধ্যে জোনাকিও আছে। জোনাকিরাও নিশাচর।
আমি চাই জোনাকীর আলো এখনও আগের মতোই ঝলমলে জ্বলতে থাকুক, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন তাদের দেখতে পায়।
এমন কিছুই খুজছিলাম
উত্তরমুছুন